মগধের উত্থান - Rise of Magadha

ভারতবর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পায় পরবর্তী বৈদিক যুগে মানুষ যেমন স্থায়ী বসবাস শুরু করেছিল তেমনি সংঘবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছিল জনপদ। এই রকম ষোলটি অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আয়তন যুক্ত ও শক্তিশালী জনপদ অর্থাৎ ষোড়শ মহাজনপদ রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ক্রমে চারটি জনপদ ( কোশল, মগধ, অবন্তি, বৎস) অপর জনপদগুলিকে গ্রাস করে প্রধান হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত মগধ সকল প্রতিদ্বন্ধিকে পরাস্ত করে এক অখণ্ড সাম্রাজ্য স্থাপন করে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে মগধের এই উত্থান কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। বিভিন্ন কারণ পৃথক ও যুগ্ম ভাবে এই উত্থানকে সম্ভব করে তোলে।

প্রাকৃতিক সুরক্ষাঃ-

  • গঙ্গা, শােন ও চম্পা নদীর প্রাকৃতিক পরিখার দ্বারা সুরক্ষিত ছিল মগধ।
  • প্রথম রাজধানী রাজগৃহ পাঁচটি পাহাড় বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি, চৈত্যক দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় খুবই নিরাপদ ছিল।
  • পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা, শােন ও গণ্ডক নদীর সংগমস্থলে অবস্থিত হওয়ায় কার্যত দুর্ভেদ্য ছিল।
  • চতুর্দিকে নদী থাকায় শত্রু দ্বারা পাটলিপুত্রের আক্রান্ত হওয়ার সস্তাবনা যেমন ছিল খুবই কম, তেমনি নদীপথ ধরে মগধের সেনাবাহিনী অবাধে চতুর্দিকে চলাফেরা করতে পারত।

নিরাপদ দূরত্ব : অনিশ্চিত ও উপদ্রুত উত্তর পশ্চিম সীমান্ত থেকে বহুদূরে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় অবস্থিত হওয়ায় বহিরাগত কোনও শক্তির পক্ষে মগধ আক্রমণ করা সহজসাধ্য ছিল না। ফলে তারা বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে মগধকে রক্ষা করা অপেক্ষা সাম্রাজ্য বিস্তারকে প্রাধান্য দিয়েছিল।

অরণ্য সম্পদ : মগধের পূর্বাঞ্চলে ছিল হস্তিসংকুল ঘন অরণ্য। এই অরণ্য একদিকে যেমন মগধকে আর্থিক সমৃদ্ধি দিয়েছিল অন্য দিকে ওই অরণ্য থেকেই হস্তি সংগ্রহ করে নন্দ রাজারা বিশাল রণহস্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিল।

উর্বর জমি : গঙ্গা ও অন্যান্য নদীগুলির পর্যাপ্ত জল ও পলি বিধৌত উর্বর জমি এবং লোহার তৈরি কৃষি সরঞ্জামের ব্যবহার মগধকে শস্য-শ্যমলা করে তুলেছিল। ফলে বিশাল জনসংখ্যা ও সেনাবাহিনীর ভরণ পােষণ যেমন সহজতর হয় তেমনি আর্থিক দিক থেকেও মগধকে সমৃদ্ধ করে তোলে।

খনিজ সম্পদ : খনিজ সম্পদে পূর্ণ মগধের তামা ও লােহার খনিগুলি ছিল মগধের আর্থিক সমৃদ্ধি ও সামরিক শক্তির প্রধান সহায়। কেবলমাত্র দৈনন্দিন জীবনে নয়, কৃষি যন্ত্রপাতি এবং যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণে লােহা ও তামার ব্যাপক ব্যবহার তৎকালীন মগধে প্রচলিত ছিল। কৌটিল্যর মতে, মগধের লৌহখনিগুলি ছিল তার সামরিক শক্তির গর্ভগৃহ।

বৈদেশিক বাণিজ্য : বৌদ্ধ গ্রন্থ "জাতকে" মগধের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্তহা বলা আছে। নদীগুলির মাধ্যমেই বঙ্গোপসাগর হয়ে দক্ষিণ ভারত ও সুদূর প্রাচ্যে পাড়ি দিত। জলপথ ছাড়াও স্থলপথে মগধের বণিকরা কাশ্মীর ও গান্ধারে চলে যেত।

যোগ্য নেতৃত্ব : বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপদ্ম নন্দ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং অশােকের মতাে সমরকুশলী, দক্ষ ও উদ্যমী শাসক এবং বাসসাকর, কৌটিল্য ও রাধাগুপ্তের মতাে ভারতবিখ্যাত কুটনীতিবিশারদ মন্ত্রীদের আগমন মগধের উত্থানের অন্যতম কারণ।

হর্যঙ্ক বংশ(Haryanka dynasty):-

  • মগধ বর্তমানের বিহারের পাটনা, গয়া আর বাংলার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত ছিল।
  • ভারতীয় ইতিহাসে এই রাজবংশ ‘পিতৃহন্তা রাজবংশ’ নামে পরিচিত। কারন এই বংশীয় রাজাদের প্রায় সকলেই পিতৃহত্যার মাধ্যমে সিংহাসন আরোহন করেছিলেন।

বিম্বিসার ( ৫৪৫ – ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
  • তিনি ছিলেন মগধে হর্যঙ্ক বংশের প্রতিষ্ঠাতা।
  • তিনি অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত করে অঙ্গ দখল করে নেন এর ফলে অঙ্গ অন্তর্ভুক্ত চম্পা বন্দরের মাধ্যমে মগধের সামুদ্রিক ও অন্তর্বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
  • বিম্বিসার বৈবাহিক রীতিতে সাম্রাজ্যবিস্তার করেছিলেন।
    • কোশলরাজ প্রসেনজিতের ভগিনী কোশলদেবীকে বিবাহ করে যৌতুক হিসেবে কাশী লাভ করেন। এই স্থান থেকে তিনি প্রায় বছরে এক লক্ষ মুদ্রা রাজস্ব পেতেন।
    • বৈশালীর লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্লনাকে বিবাহ করেন।
    • বিদেহ রাজকন্যা বাসবিকে বিবাহ করেন।
    • মদ্র রাজকন্যা খেমাকে বিবাহ করেন।
  • রাজগৃহ শহরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং গিরিব্রজ থেকে তিনি রাজগৃহে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।
  • তিনি শ্রেণিক বা সেনিয়া ( Seniya ) নামেও পরিচিত ছিলেন।
  • তিনিই প্রথম ভারতীয় রাজা যার স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল।
  • তাঁর রাজবৈদের নাম ছিল জীবক। অবন্তীরাজ প্রদ্যোতের চিকিৎসার জন্য তিনি জীবককে অবন্তী নগরে প্রেরণ করেছিলেন।
  • মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ দুজনেই বিম্বিসারের সমসাময়িক ছিলেন।
  • তাঁর আমলে কার্যপণ (রূপা ও তামা নির্মিত) মুদ্রার প্রচলন ছিল।
অজাতশত্রু ( ৪৯২ – ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
  • এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা।
  • পিতা বিম্বিসারকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন বিম্বিসারের দ্বিতীয় পত্নী লিচ্ছবি রাজকন্যা চেল্লনার গর্ভজাত পুত্র অজাতশত্রু। সিংহাসনে আরােহণের পূর্বে তিনি ছিলেন চম্পার শাসক।
  • স্বামী শোকে কোশলদেবী প্রাণত্যাগ করায় কোশলরাজ প্রসেনজিৎ বিম্বিসারকে যৌতুক হিসেবে প্রদত্ত কাশী গ্রাম পুনর্দখল করেন নেন এবং অজাতশত্রু ও প্রসেনজিতের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়।
  • দীর্ঘ সংঘাত চলার পরে শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষে সন্ধি হয় – ফলস্বরূপ প্রসেনজিৎ কাশী ফেরত পান এবং প্রসেনজিতের কন্যা ভজীরা কুমারীর সাথে অজাতশত্রুর বিবাহ হয়।
  • বৃজি ও ৩৬টি গণরাজ্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ১৬ বছর যুদ্ধ করার পরে অজাতশত্রু বৃজি দখল করেন। বৃজি জয়ের তার প্রধান অস্ত্র ছিল –
    • সুনিধা ও ভৎসাকর – মন্ত্রী
    • রথমুসালা – তীক্ষ্ণ লোহা ফলকযুক্ত এবং ধাতুনির্মিত এক ধরনের দুর্ভেদ্য রথ
    • মহাশীলাকণ্টক – উৎক্ষেপণ যন্ত্র যা দিয়ে শক্রসেনা লক্ষ্য করে বড়ো বড়ো পাথরের টুকরো নিক্ষেপ করা হত
  • লিচ্ছবীদের কাছ থেকে বৈশালী দখল করেন, কোশল জয় করেন এবং কুনিক উপাধি ধারণ করেন।
  • তিনি রাজগৃহে একটি দুর্গ তৈরী করেন এবং পাটলিগ্রামে একটি পর্যবেক্ষণ দুর্গ ( Watch Fort ) তৈরী করেন।
  • তাঁর আমলে ৪৮৩ খ্রিঃপূঃ কুশীনগরে এশিয়ার আলো গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয়।
  • তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ৪৮৩ খ্রিঃপূঃ রাজগৃহের সপ্তপর্ণী গুহায় মহাকশ্যপের সভাপতিত্বে প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতি/সম্মেলন আয়োজিত হয়।
উদয়ীন / উদয়ভদ্র ( ৪৬০ – ৪৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
  • পিতা অজাতশত্রুকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
  • গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গমস্থলে পাটলিপুত্র শহরটি স্থাপনা করেন এবং নিজ রাজধানী সেখানে স্থানান্তরিতো করেন। পাটলিপুত্র চর্তুদিকে জলবেষ্টিত হওয়াই একে ‘Water Fort’ বা ‘জলদূর্গ’ বলা হতো।
  • সভাকবি ভাস ‘স্বপ্নবাসদত্তা’ ও ‘প্রতীমা’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন।
  • উদয়ীন জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

উদয়ীনের পরে তিনজন দুর্বল হর্যঙ্ক রাজা সিংহাসনে বসেন – অনুরুদ্ধ( ৪৪৪ – ৪৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ), মুন্ডা( ৪৪০ – ৪৩৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ ) এবং নাগদশক ( নাগদাস, ৪৩৭ – ৪১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) । বৌদ্ধ গ্রন্থে এদের তিনজনকেই পিতৃহন্তা বলা হয়েছে।

হর্যঙ্ক বংশের শেষ রাজা নাগদশককে হত্যা করেন তাঁর সভাসদ শিশুনাগ এবং শিশুনাগ রাজবংশ মগধে রাজত্ব শুরু করে।

শিশুনাগ বংশ(Shaishunaga dynasty):-

শিশুনাগ ( ৪১৩ – ৩৯৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
  • হর্যঙ্ক বংশের শেষ রাজা নাগদশকের মন্ত্রী শিশুনাগ নাগদশককে হত্যা করে মগধ রাজ্যে শিশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ৪৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
  • তিনি শিশুনাগ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন।
  • শিশুনাগ তার রাজধানী প্রথমে পাটলিপুত্র থেকে গিরিব্রজ ও পরে বৈশালীতে স্থানান্তরিত করেন।
  • অবন্তীরাজ প্রদ্যোৎকে পরাজিত করে অবন্তী মগধের অন্তর্ভুক্ত করেন ।
কালাশোক ( ৩৯৫ – ৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ )
  • শিশুনাগ বংশের শেষ উল্লেখযোগ্য রাজা ছিলেন কালাশোক।
  • তিনি স্থায়ী ভাবে রাজধানী বৈশালী থেকে পাটলিপুত্রে স্থানান্তরিত করেন।
  • কালাশোক ৩৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংহতি করেছিলেন।
  • মহাপদ্মনন্দ কালাশোক-কে হত্যা করলে তাঁর দশ পুত্র পর পর মগধের সিংহাসনে বসেন। শিশুনাগ বংশের শেষ রাজা ছিলেন মহানন্দীন।

নন্দ বংশ(Nanda Dynasty):-

মহাপদ্মনন্দ :
  • মহাপদ্মনন্দ মহানন্দীন-কে হত্যা করে মগধে নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন।
  • পুরান, এবং জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থে মহাপদ্মনন্দকে নীচবংশ-সম্ভূত বা শুদ্র বলা হয়েছে এবং ক্ষৌরকার ছিলেন।
  • পুরান, এবং জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থমতে নন্দরা মগধের প্রথম অক্ষত্রিয় রাজবংশ ছিলেন এবং মহাপদ্মনন্দ ছিলেন প্রথম অক্ষত্রিয় রাজা।
  • পুরানে মহাপদ্মনন্দকে একরাট (একচ্ছত্র সম্রাট ), সর্বক্ষত্রিয়ছেত্তা বা সর্বক্ষত্রান্তক (সকল ক্ষত্রিয় রাজার উচ্ছেদকারী ) এবং দ্বিতীয় পরশুরাম বলা হয়েছে।
  • তাঁর বিশাল সৈন্যের জন্য মহাপদ্মনন্দকে উগ্রসেনা বলা হতো।
  • ড: রাধাকুমুদ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মতে, “মহাপদ্মনন্দ ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম মহান ঐতিহাসিক সম্রাট”।
  • তিনি কলিঙ্গে একটি সেচখাল নির্মাণ করেন।
  • মহাপদ্মনন্দের পরে তাঁর আট পুত্র( পাণ্ডুকা, পাণ্ডুগতি, ভূতপাল, রাষ্ট্রপাল, গোভিশঙ্ক, দাসসিদ্ধক, কৈবর্ত এবং ধননন্দ) পর পর সিংহাসনে বসেন। তাই নন্দদের "নবনন্দ" বলা হয়। মহাপদ্মনন্দের আট পুত্রের মধ্যে ছোট পুত্র ধননন্দ ছিলেন সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য
ধননন্দ :
  • নন্দ বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধননন্দ।
  • গ্রিক সাহিত্যে তাঁকে অগ্রামিস (Agrames) বলা হতো।
  • ধননন্দ ছিলেন জৈন ধর্মালম্বী।
  • ধননন্দের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্রে।
  • ধননন্দের বিশাল সেনাবাহিনীতে ছিল –
    • ২০,০০০ – অশ্বারোহী
    • ২০০,০০০ – পদাতিক বাহিনী
    • ২,০০০ – রথ
    • ৩,০০০ – হস্তী ছিল ।
  • তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর জন্যই বিশ্বজয়ী আলেক্সজেন্ডার তাঁর আমলে ভারত আক্রমণ করলেও মগধ আক্রমন করতে সাহস করেননি।
  • এই বিশাল সেনাবাহিনীর ব্যয় নির্বাহের জন্য ধননন্দ জনসাধারণের উপর প্রভূত কর চাপিয়েছিলেন। এরফলে প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। যা চন্দ্রগুপ্ত এর মৌর্য বংশের উত্থানের সহায়ক হয়।